ইয়ারকেন গড় – তিব্বতের এক অজানা ভুবনের গল্প
চিনের শাসনাধীন তিব্বত এর একটি সমতল ভূমির একটি গ্রামের নাম ইয়ারকেন গড় । ইয়ারকেন গড়, ‘ইয়াকেন ওয়ারগ্যান মঠ’ নামেও পরিচিত। এটি জিন-চু নদীর ধারে, গার্জি এলাকার একটি সমতলভূমিতে অবস্থিত । এখানে প্রায় দশ হাজার নিয়িংগমা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের বাস এবং এদের মধ্যে নারীসংখ্যাই বেশি । তাদের মধ্যে কেউ তাদের কুঁড়েঘরে ধ্যানরত অবস্থায় আছে, কেউ ছুটছে গুরু লামার দীক্ষা নিতে, কেউ বা একমনে প্রার্থনা করছে। গার্জি এলাকার পুরো একটি গ্রাম জুড়ে স্থাপিত এই আশ্রমের নাম ‘ইয়ারকেন গড়’। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে চার হাজার মিটার উপরে অবস্থিত এই আশ্রম । এই আশ্রমটি বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ আশ্রমগুলোর একটি। ইয়ারকেন গড়ের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন লামা রিনপুচে, ১৯৮৫ সালে।
এই আশ্রমটি, পুরোনো তিব্বতী প্রদেশ চিংদু হতে ৪০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এর কাছাকাছি অবস্থিত ‘লাড়ুং গড়’ এর থেকে আয়তনে বড় হওয়া সত্ত্বেও আশ্রম হতে এই গড় সন্ন্যাসীদের ধর্মশিবির হিসেবে বেশি পরিচিত। গার্জি শহর থেকে মিনিভ্যানে করে ইয়ারকেন গড়ে পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘন্টার মতো লাগে। বাইরের পর্যটকদের থাকার জন্য মাত্র একটি হোটেল রয়েছে এখানে, নাম ইয়া কিং হোটেল। ১২০ ইয়ানের মতো খরচ হয় এক রাত থাকার জন্য। কিন্তু থাকার সময় এখানে বিলাসিতা একদমই আশা করা যাবে না। গ্রামজুড়ে স্থাপিত বিশাল আশ্রমের জীবনব্যবস্থার মতো এখানে সবকিছুই সেকেলে এবং খুবই সাদামাটা। হোটেলের নিচতলায় রেস্তোরাঁ রয়েছে, কিন্তু এখানে কোনো মেন্যু পাওয়া যাবে না। মাংস ভক্ষণ এখানে নিষিদ্ধ। হোটেলের প্রবেশপদ্বারের দু’পাশে ছোট ছোট দোকান রয়েছে যেখানে স্যুপ, রুটি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র মিলবে।

ইয়ারকেন গড়
২০০১ সালে বেইজিং ও চেংদুর কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদকারী অভিযান চালালে, হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসী লাড়ুং গড় হতে পালিয়ে ইয়ারকেন গড়ে অবস্থান নেয়। লাড়ুং গড়ে তাদের বাড়িঘরও ধ্বংস করে দেয়া হয়। লাড়ুং গড়ে জুন ২০১৬ সাল থেকে বাইরের পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও, ইয়ারকেন গড় সকলের জন্য উন্মুক্ত। লাড়ুং গড় পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত, আর ইয়ারকেন গড়ের চারদিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী।
আশ্রমে যাওয়ার পথে গুরু রিমপুচের প্রতিমা যে পাহাড়ে অবস্থিত, তার চূড়া থেকে পুরো গ্রামটি দেখা যায়। গ্রামের মাঝে অবস্থিত বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের ছোট ছোট কুঁড়েঘর, পশ্চিমাংশে পুরুষ ভিক্ষুদের ঘর- সবই চোখে পড়ে এখানে থেকে। পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে ভিক্ষুণীদের ধ্যানশালা। এই ধ্যানশালাগুলো কাঠ, লোহার পাত দিয়ে বানানো; কয়েকটা আবার কাপড় এবং স্বচ্ছ কাঁচের তৈরী। কিছু কিছু মঠবাসিনী দিনের প্রায় ২৪ ঘণ্টা নিজেদের ধ্যানশালায় থেকে ১০০ দিনের মতো ধ্যানরত থাকেন। কেবলমাত্র প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বা খাবার খেতে নিজেদের ধ্যান ছেড়ে তারা ওঠেন। ধ্যানরত থাকার পাশাপাশি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ছোট ছোট দোকান চালান। এসকল দোকানে আলখাল্লা, টুপি (হলুদ টুপি গেলুগ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এবং লাল রঙের টুপি শাক্যদের জন্য বানানো), জুতা, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি (কিছু সন্ন্যাসী হেডফোন এবং স্মার্টফোনও আজকাল ব্যবহার করছেন)সহ অন্যান্য জিনিসপত্রের দেখা মেলে।
ভিক্ষুগণ, ভিক্ষুণীদের বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেন না- ইয়ারকেন গড়ে এই নিয়মটি বেশ কড়াভাবে পালন করা হয় এবং তা পরিদর্শনকারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আশ্রমে অবস্থানকারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কঠিন সময় অতিবাহিত করেন নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠাতা লামা রিনপুচের শিক্ষার ছাপ রাখার জন্য। লামা রিনপুচের এই জীবনমুখী শিক্ষাগুলো ধ্যান, পরিশ্রম ও কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্তের মধ্যে দিয়ে জীবনকে উপজীব্য করার কথা বলে। আশ্রমের কাছেই রয়েছে একটি পাহাড়, যাকে কেন্দ্র করে একটি বৃত্তাকার পথ রয়েছে; এই পথ ধরেই মূলত আশ্রমের ভিক্ষুগণ ‘কউটোও’ পালন করেন। ‘কউটোও’ হচ্ছে একপ্রকারের প্রার্থনা, যেখানে এই বৃত্তাকার পথ ধরে হাঁটার সময় প্রতি দুই পদক্ষেপের পর তারা উবু হয়ে মাটিতে নিজেদের কপাল ঠেকিয়ে শান্তি ও প্রজ্ঞাপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করে। আবহাওয়া যেমনই হোক, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত, হাজার হাজার ভিক্ষু-ভিক্ষুণী প্রাঙ্গণে উপস্থিত হোন প্রধান লামার কথা শুনতে এবং প্রার্থনা করতে।
ইয়ারকেন গড়ের পুরো এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক মঠ (এদের বেশিরভাগই ভিক্ষুণীদের কুঁড়েঘরগুলো আশেপাশে অবস্থিত), যেগুলোতে দিনের বেলা ধর্মীয় বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলে। মঠগুলোর ছাদ থেকে গ্রামটির এবং আশেপাশে ঘিরে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মনোরম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। পর্যটকদের জন্য মঠগুলো সার্বিকভাবে উন্মুক্ত।

ইয়ারকেন গড়
পাহাড়ের চূড়া থেকে আশ্রমের যে সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয়, তার অনেকখানিই ফিকে হয়ে আসে কাছে গেলে। কাছে গেলেই পুরো গ্রাম জুড়ে আবাসনের নাজেহাল অবস্থা সহজেই চোখে পড়ে। দেখা যায়, বেশিরভাগ বাড়িই কাদামাটির, পাতলা কাঠ ও পুরনো ধাতব দিয়ে তৈরী- যা শীতকালে বসবাসকারীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পানির কোনো সুব্যবস্থা নেই, বৃষ্টির পানি দিয়ে কাজ চালাতে হয়। পয়ঃনিষ্কাশনের তেমন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা না থাকার জন্য বিভিন্ন জায়গা হতে মূত্রের গন্ধ ভেসে আসে।
গত কয়েক বছরে, এখানকার জনসংখ্যা এত তুমুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ নারী ও পুরুষ সন্ন্যাসীদের আলাদাভাবে বসবাসের নিয়ম জারি করেছেন। সেইসাথে পুরুষ ও নারীদের বসবাসের এলাকাও আলাদা করে দিয়েছেন। ইয়ারকেন গড়ে বসবাসকারী সন্ন্যাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী হয়ে থাকায় ইয়ারকেন গড়কে বলায় হয় ‘মঠবাসিনীদের শহর’ বা ‘The city of nuns.’ দু বছর পর্যটকদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখার পর, পুলিশি পাহারায় মোটামুটি কঠোর নজরদারিতে ইয়ারকেন গড়ে বাইরের দর্শকদের আসতে অনুমতি দেয়া হয়। আশ্রমে অবস্থানকারী বেশিরভাগ ভিক্ষুক তিব্বতী, তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মান্দারিন ভাষায় কথাবার্তা চালাতে পারে। গার্জি শহরবাসীরা নিজেদেরকে আদিম তিব্বতীদের বংশধর বলে দাবি করলেও, এই বক্তব্য কতটুকু সত্য, এ নিয়ে অনেকটুকু ধোঁয়াশা রয়েছে।
অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে এখানকার তপস্যারত একেকজন সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্য থাকে বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কারের সাথে সাথে জীবনকে আরও পরিপূর্ণ করে তোলা।